গল্পের নাম: আদনান ।*** আবিদ হোসেন জয় ***

গল্পের নাম: আদনান
---------------------------------
*** আবিদ হোসেন জয় ***
১) লুকিয়ে ভাড়া ফাকি দিয়ে যাত্রীবাহী বাস থেকে নেমে ফুটপাতে পা রাখল আদনান। গায়ে কড়া ইস্ত্রির খড়খড়ে শার্ট, জিন্স প্যান্ট আর পায়ে পালিশ করা চকচকে কালো জুতো। আদনান পকেটে হাত দিল, বাম পকেটে ভাজ করা একটা চিঠি আর ডান পকেট শূণ্য। এই নিয়ে প্রায় দশবার পকেট খুতিয়ে দেখা হয়ে গেছে। ২০টাকার নোটটা যে কোথায় উধাও হল এখনও মাথায় ধুকছে না আদনানের।বিংশ শতাব্দীর মানুষের মত আদনানের কাছে এই বিশ টাকার মূল্য অনেক। এই সামান্য টাকার জন্য তাকে করতে হয়েছে অক্লান্ত পরিশ্রম। আদনানের বাবা-মা অনেক বছর আগেই গত গেছেন। তার একমাত্র অভিভাবক তার চাচা। জীবন সম্পর্কিত তার চাচার দুটি উক্তি রয়েছে।
১) টাকা কোন সস্তা কাগজের টুকরো না যা চাইলেই পাওয়া যায়।
২) বই পুস্তক থেকে অর্জিত শিক্ষা দ্বারা শুধু গেয়ানের ভান্ডার বৃদ্ধি করলেই হয় না বরং তা জীবনের প্রতিমুহূর্তে প্রয়োগ করতে হয়।
আদনান প্রতিনিয়ত তার চাচার কথাগুলো অনুসরণ করে। চাচার দ্বিতীয় উক্তিটি তার অনেক পছন্দের। আদনান বেশি দূর পড়ালেখা করতে পারে নি। সে মাত্র ক্লাস সিক্স পাশ। তবুও সে তার পড়া সবচেয়ে পছন্দের সূত্রটি জীবনের প্রতি মুহূর্তে প্রয়োগ করে থাকে। প্লাস মাইনাসের সূত্র, মাইনাসে মাইনাসে প্লাস আর প্লাসে মাইনাসে মাইনাস। নিজের জীবনে এই সূত্র প্রয়োগ করতে পারলেই সে নিজেকে তার চাচার বাধ্য ভাতিজা হিসেবে আখ্যায়িত করে। তার ধারনা সে তার অর্জিত শিক্ষা তার জীবনে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছে।
ইতোমধ্যেই আদনান বিশ টাকার কথা ভুলে গিয়েছে। আপাতত তার টাকার প্রয়োজন নেই। একটু সামনে গিয়ে বায়ে মোড় নিলেই ২৬ নম্বর বাসা। আর সেটাই তার গন্তব্য। আদনান টাকার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল। খালি জায়গা পেয়ে এক নতুন চিন্তা আদনানের মাথায় ভর করল। তা ইতোমধ্যেই মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। আদনান একটা নেগেটিভ কাজ করে ফেলেছে। সে বাসের ভাড়া দেয় নি। তাকে সর্বদা পজিটিভ থাকতে হবে। আর তার জন্য তাকে আরও একটি নেগেটিভ কাজ করতে হবে। এই চিন্তা আদনানের বেশ পরিচিত এবং খুব পছন্দনীয়।
আদনান তার গন্তব্যে পৌছে গেছে। সে এখন আফসার সাহেবের বাসার ড্রইংরুমে। ড্রইংরুমটা বেশ সুন্দর। নানান শৌখিন উপকরন দিয়ে সাজানো। দেয়ালে দেয়ালে ঝোলানো রয়েছে বিভিন্ন শিল্পকর্ম।উত্তর দিকের শোকেসটা বাহারী সব শোপিস দিয়ে সজানো। আদনান চারদিক মনযোগ দিয়ে দেখছে। আদনান হাতের ঘড়ির দিকে তাকাতেই তার মনে হল সে বিশ মিনিট ধরে এখানে অপেক্ষা করছে। অথচ কেউ এখনো আসেনি। হঠাৎ তার মনে হল সূত্রের খেলাটা এখনই খেলতে হবে। আর একটা নেগেটিভ কাজ করতে হবে যার ফলস্বরুপ পাওয়া যাবে প্লাস। সে উত্তর দিকের শোকেসটার দিকে দৃষ্টি দিল। একটা ছোট কাঁচের শোপিস ডান হাতে নিল। খানিকটা সময় শোপিসটা খুতিয়ে দেখে হঠাৎ হাত থেকে ছেড়ে দিল। মাটিতে পড়তেই ঝন ঝন শব্দে ভেঙ্গে গেল শোপিসটি।
আর বেশি সময় আদনানকে অপেক্ষা করতে হল না, একজন লোক তাৎক্ষনিক রুমে প্রবেশ করল। আদনান ভুরু কুচকানো চোখে তাকালো লোকটির দিকে। লোকটির গায়ে লুঙ্গি আর ফতুয়া, প্রকান্ড মুখে চামড়ার ভাজ আর কপালে কাটা দাগ, ভালই বয়স লোকটার তা বোঝা যাচ্ছে। খানিকটা তীক্ষ্ন স্বরে বলল, " কি করলেন আপনি এইডা?? এত সুন্দর জিনিসটা ভাইঙ্গা লাইলেন??" আদনান কে কোন উত্তর দিতে হল না, আদনান আফসার সাহেবের উপস্থিতি তের পেল। আদনানের মনে খানিকটা আনন্দ কাজ করছে, তার সূত্র সূত্র খেলা কাজে লেগেছে। মাইনাসে মাইনাসে প্লাস। আফসার সাহেবের উপস্থিতি আর সেই সাথে আদনানের অপেক্ষার অবসান প্লাস হিসেবে ধরা যায়।
|২|
মুখোমুখি হয়ে বসে আছে আদনান এবং আফসার সাহেব। দু'জনের হাতেই চা এর কাপ। আফসার সাহেব আদনানের দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে বলল, "আমার চিঠিটা দাও"। আদনান চিঠিটা বের করে তার দিকে এগিয়ে দিল। আফসার সাহেব চিঠিতে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন-
প্রিয় আফসার,
জানি তুই ভাল নেই। তুই বলেছিলি তোর বড় সমস্যাটার সমাধান করে দিতে। তবে আমার দৃষ্টিতে সমস্যাটা অনেক ছোট। তাই আর নিজে এলাম না। আমার ভাতিজাকে পাঠিয়ে দিলাম। অর নাম আদনান। তুই শুনলে অবাক হবি ও মাত্র ক্লাস সিক্স পাশ তবে অর জ্ঞান ভান্ডারে যথেষ্ট পরিমান জ্ঞান রয়েছে যা তোকে বুঝতেই দিবে না যে ও একজন অশিক্ষিত। এটা কি করে সম্ভব তা আমি নিজেও বুঝতে পারি না। আমার বিশ্বাস ও তোর সমস্যা সমাধান করবে। ওকে আমি আমার সন্তানদের থেকেও বেশি ভালবাসি। লভা কিসথা।
ইতি
তোর বন্ধু
আফসার সাহেব চিঠিটা ভাজ করে পকেটে রাখলেন তবে চিঠির শেষ লাইনটা তাকে ভাবাচ্ছে। "লভা কিসথা" মানে কি? অন্য কোন ভাষায় লিখা? নাকি বানান ভুল? আফসার সাহেব ভাবনার অবসান ঘটালেন। শব্দ করে চা এর কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, " তুমি কি জানো? ইংরেজি শব্দ "absolve" এর বাংলা কি??"।
ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে আদনান উত্তর দিল- হ্যা জানি,"absolve" এর বাংলা "মুক্তিদান করা", আর এটাও জানি আপনি আমাকে এই প্রশ্নটা কেন করলেন।
আফসার সাহেব ভুরু কুচকে বললেন- কেন করলাম?
-আমার চাচার কথাগুলো যাচাই করবার জন্য, আমি যে সিক্স পাশ হয়েও অনেক কিছু জানি এই ব্যাপারটা আপনি একটু পরোক্ষ করে দেখলেন।
আদনান একটু থেমে আবার বলল- এই চিঠিটায় দুটো মিথ্যে কথা আছে, ১)চাচার চোখে আমি অশিক্ষিত হয়েও শিক্ষিত আর এটা কি করে সম্ভব তা সে বুঝতে পারেনা। ২) সে আমাকে তার সন্তানদের চেয়েও বেশি ভালবাসে
আফসার সাহেব খানিকটা অবাক হয়ে বলল- মিথ্যে কেন?
- প্রথমত আমার চাচা সরকারি কলেজের একজন পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন,সে রিটায়ার্ড করেছেন নয় বছর হয়ে গেছে, রিটায়ার্ডমেন্টের পর প্রতিনিয়ত সে বিভিন্ন বই-পুস্তক থেকে জ্ঞান
অর্জনে ব্যস্ত থাকে আর আমি দিনের ২৪ঘন্টার মধ্যে ১২ঘন্টাই তার সাথে খাকি। তাই তার থেকে আমার অনেক কিছু শেখাই স্বাভাবিক। আর দ্বিতীয়ত সে বলেছেন সে আমাকে তার সন্তানদের থেকেও বেশি ভালবাসে, কোন বাবার পক্ষেই তা সম্ভব নয়, মানুষের মুখ অনেক কথা বললেও পরিস্থিতি সর্বদা সত্য কথা বলে।
- তুমি কি করে জানলে চিঠিতে এসব লিখা আছে?তার মানে কি তুমি চিঠিটা আগে পড়েছ??
- না পড়িনি, তবে মাঝেমাঝেই আমাকে চিঠি নিয়ে বিভিন্ন কাজে পাঠানো হয়, আমি একবার তার দুটো চিঠি পড়েছিলাম, দু'বারই একই কথা লিখতে দেখেছি তাই আমার ধারনা চাচা সব সময় আমার ব্যাপারে এই দুটো কথাই লিখে।
আফসার সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। খানিকটা আগ্রহ নিয়ে বললেন- তুমি কি জান? "লভা কিসথা" মানে কি? চিঠির এই শেষ লাইনটা আমি বুঝতে পারছিনা। আদনান মৃদু হেসে বলল- এটা চাচার একটা খেলা, কিছু একটার মাধ্যমে সে মানুষকে চিন্তায় ফেলতে পছন্দ করেন, এই যে আপনি এখন সর্বক্ষন চিন্তা করবেন "লভা কিসথা" মানে কি, তবে আমি আপনাকে যাওয়ার সময় এর মানে বলে দিয়ে যাব এখন আপনি আমাকে আপনার সমস্যার কথা বলেন আমাকে কেন এখানে পাঠানো হয়েছে।
-আমি দিনে দিনে মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছি, জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমার মনে হচ্ছে আমি সারাজীবন অনেক ভুল করেছি, নিজেকে মাঝে মাঝে খুনি বলেও মনে হয়। অন্যদিকে আমার মেয়ে,মিতু আমার সঙ্গে কথা বলছেনা, সারাদিন মায়ের শোকে একা ঘরে বসে থাকে অথচ ওর মা যখন মারা যায় ও তখন ছোট। মায়ের জন্য খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক কিন্তু এত বছর পর এসে মায়ের কথা ভেবে এক ঘরে বসে থাকার অর্থ আমি বুঝতে পারছিনা, আমার মনে হয় ও আমায় সর্বদা সন্দেহের চোখে দেখে।
- কিসের সন্দেহ?
- তা আমি জানিনা।
- আচ্ছা আমি ব্যাপারটা দেখছি।
আদনানের মনে হচ্ছে আফসার সাহেবের নিজেকে খুনি মনে করা, তার মেয়ের বিষন্নতা ও এত বছর পর মায়ের জন্য এত শোক এই তিনটে রহস্য এক সুতোয় বাধা। আদনান চিন্তিত ভঙ্গিতে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো ঘন্টার কাঁটা দুটোর ঘরে, মিনিটের কাঁটা ১টার ঘরে আর সেকেন্ডের কাঁটা অনবরত ঘুরছে।
|৩|
ঘরে প্রবেশ করেই আদনান দেখল পাতলা একটা চাদর আষ্টেপৃষ্ঠে কয়েকপাক জড়িয়ে চওড়া একটা বিছানায় শুয়ে আছে মিতু। বিছানার পাশে রাখা টেবিলের উপর একটা খোলা ডায়েরি। আদনান ডায়েরি হাতে নিতেই মনে হল এটা অনেক পুরোনো ডায়েরি, কালি গুলো কাগজের সাথে কেমন যেন লেগে গেছে, প্রতিটি পাতায় হলদে ছাপ। খুলে রাখা পৃষ্ঠাটার দিকে আদনান তাকালো, ছোট করে দুটো লাইন লিখা-
"আমার বসবাস ভালবাসাহীন বিদ্বেষপূর্ণ এক পৃথিবীতে। তার মিথ্যে ভালবাসা প্রতিনিয়ত আমার অস্তিত্বকে শুষে নিচ্ছে"।
আদনান শ'খানেক পৃষ্ঠা উল্টোবার পর আর ও দু'টো লাইন খুঁজে পেল-
"আমি চিৎপাত হয়ে পড়ে গেলাম,আমাকে ওঠালো কপাল কাঁটা লোকটি"।"তার মুখ থেকে শোনা অপ্রত্যাশিত সত্য আমায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে, মৃত্যু আমায় ডাকছেনা আমি মৃত্যুকে ডাকছি"।
আদনান ডায়েরিটি আগের অবস্থায় রেখে দিল। নিশ্বব্দে মিতুর বিছানার পাশে বসে হাত বুলোতে শুরু করল মিতুর মাথায়। মিতু শোয়া থেকে উঠে গেছে। আদনানের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, "কে আপনি?"
আদনান মৃদু স্বরে বলল," কেমন আছিস? আমি তোর মামা,আদনান মামা।" মিতু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদনানের দিকে। আদনান খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল," আরে আমি তোর সেই মামা, ছোটবেলায় তোকে কত কোলে নিয়েছি তুই হয়ত ভুলে গেছিস"। মিতু এক লাফে বিছানা থেকে উঠে পড়ল, উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করল, " মামা তুমি এসেছ? তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে, তুমি বস আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি"। মিতু বাষ্পের গতিতে ওয়াশরুমে ধুকে গেল। আদনানের ধারণাটা সঠিক, মিতু তার বাবাকে সন্দেহ করছে।খুব কঠিন সন্দেহ, মিতুর ধারনা তার মা খুন হয়েছিল আর তার মার খুনি তার বাবা। এখন তার মার যে কোন আত্মীয়কে খুব আপন মনে হবে। তাই তো মামা বলতেই খুশী হয়ে গেল। আপন মামা নাকি দূর সম্পর্কের মামা এত কিছু চিন্তা করেনি।
ঘুরন্ত ফ্যানের নিচে বসে আছে মিতু আর আদনান। আদনানের হাতে পুরোনো ডায়েরিটি। আদনান পৃষ্ঠা উল্টোতে উল্টোতে বলল, "আচ্ছা এই ডায়েরিটি কি তোর মার?" মিতু উত্তর দিল," হ্যা মামা, আমি এটা বাবার টেবিলে পেয়েছিলাম, ডায়েরির লিখা গুলো মার এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। আর লিখা গুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে মার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না, তার পেছনে বাবার হাত আছে"।
-থাক আর বলতে হবে না। আচ্ছা তোদের বাসার ঐ লোকটার নাম কি?"
- কে? শফিক চাচার কথা বলছ? উনাকে আমি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি আমাদের এখানে কাজ করে।
-ও আচ্ছা। তুই ভাত খেয়ে নে আমি একটু ঘুরে আসছি।
আদনান রুম থেকে বের হয়ে গেল। মিতু জালি দিয়ে ঢাকা প্লেটটি হাতে নিল। অনেক দিন তৃপ্তি সহকারে খাওয়া হয়না। মিতু মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত মাখাতে শুরু করল। এক টুকরো লেবু হলে খারাপ হত না।
|৪|
দক্ষিন দিকের ফাঁকা রুমটার মেঝেতে বিশাল শীতল পাটি বিছানো হয়েছে। সারি বেধে বসে থাকা বাচ্চাগুলোর জন্য ঢাকা পড়ে গেছে শীতল পাটির বিশেষ হস্তশিল্প। আদনান আফসার সাহেবকে জিজ্ঞেস করল,"এরা কারা?" আফসার সাহেব উৎসাহ নিয়ে উত্তর দিল," অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম কয়েকজন এতিম খাওয়াবো তাই এতিমখানা থেকে এদের নিয়ে আসলাম, এতিম বাচ্চাগুলোকে খাওয়ালে যদি আমার পাপ একটু কমে! বুঝলে আদনান?"
-হ্যা বুঝলাম
- আদনান তুমি ডাইনিং রুমে গিয়ে বসো আমি শফিককে বলছি তোমাকে খাবার দিতে।
আদনান কিছু না বলেই সোজা পাটিতে বসে গেল।আফসার সাহেব বলে উঠল, " কি করছ? কি করছ? এখানে বসছো কেন"? আদনান মৃদু হেসে উত্তর দিল," আফসার সাহেব, আপনি হয়ত জানেন না আমিও একজন এতিম,আমিও এদের দলে"। আফসার সাহেব খানিকটা সময়ের জন্য মূর্তিতে পরিণত হল।
মাগরিবের নামাজ শেষে জায়নামাজে বসে অনবরত কাঁদছে আফসার সাহেব। আদনান রুমে ধুকতেই সে মোনাজাত শেষ করে উঠে দাঁড়াল। জায়নামাজ ভাজ করতে করতে বলল, "একটু আল্লাহ'র কাছে মাফ চেয়ে চোখের পানি ফেলছিলাম, চোখের পানি ফেললে আল্লাহ অনেক বড় অপরাধও ক্ষমা করে দেন"। আদনান মৃদু হেসে বলল," হুম নিজের স্ত্রীকে খুন করা অনেক বড় অপরাধ,আল্লাহ আপনার এই অপরাধ ক্ষমা করে দিক সেটাই আমি চাই"। আফসার সাহেব অবাক হয়ে বলল-মানে?
-মানে আপনি একজন খুনি,নিজের স্ত্রীকে খুন করেছেন।
-আমি খুন করিনি,হ্যা আমি মানি ওর সাথে আমার প্রতিদিন ঝগড়া লেগেই থাকতো এমনকি আমি ওর গায়ে হাতও তুলেছি তার জন্য আমি অনুতপ্ত কিন্তু আমি খুন করিনি।
- আপনি কাউকে জানান নি কেন? যে আপনার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছিল?
-ভয়ে জানাইনি, মানুষ যদি আমাকে খুনি বলে তাই ঘটনাটা ধামা চাপা দিয়েছিলাম।
- হুম আর আজ আপনি নিজেই নিজেকে খুনি মনে করছেন।
আদনান ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
|৫|
- এই চিঠিটা তোর বাবাকে দিবি বুঝলি মিতু?
-"হ্যা মামা বুঝলাম কিন্তু চিঠি কেন? তুমি তো বাবার রুমে গিয়েই কথা বলতে পারও"- আদনানের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল মিতু। আদনান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো, মিতু পাশে বসে কাধে হাত রেখে বলল- "আমার কথা গুলো মনযোগ দিয়ে শুোন, পৃথিবীতে সাধারণত একজন মানুষ আর একজন মানুষকে তার অতীত দিয়ে যাচাই করে, কারন কিছু মানুষ আছে যারা অতীতে ভয়ংকর সব অপরাধ করে এবং তাদের বর্তমান ও থাকে সেই অপরাধের ভেতর, আর এক শ্রেনির মানুষ আছে যারা অতীতের ভুল গুলো মেনে নিয়ে এবং তার থেকে শিক্ষা নিয়ে ভালর পথে চলে আসে আর সারাজীবন থাকে কারও না কারও প্রতি অনুতপ্ত হয়ে, তোর বাবা হচ্ছে এই শ্রেণির মানুষ, তোর বাবাকে ভুল বুঝিস না।"
অন্ধকারাচ্ছন্ন ছোট এক ঘরে চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে শফিক মিয়া। আদনানের মাথায় প্রস্তুত হচ্ছে সূত্রে খেলা। পর পর দুটো মাইনাস দিয়ে প্লাস আনতে হবে। প্রথমত নিজের পরিচয় গোপন করে ছদ্মবেশ ধরতে হবে দ্বিতীয়ত শফিক মিয়াকে মিথ্যে কিছু কথা ফলতে হবে। আদনান শফিক মিয়ার গা থেকে চাদর টেনে নিয়ে ভারী কন্ঠে বলল, "ওঠো শফিক তাড়াতাড়ি ওঠো" শফিক মিয়া তৎক্ষনাত ঘুম থেকে উঠে গেল। আশেপাশে তাকাবার পর জানালা দিয়ে আসা সামান্য আলোয় সে একটা ছায়া মূর্তি দেখতে পেল। চমকে গিয়ে বলল," কে ঐখানে?" আদনান আবারো ভারী কন্ঠে বলল," আমি এক অপ্রত্যাশীত সত্য যা তোমার গলায় আটকে আছে তোমার মুখ দিয়ে প্রকাশিত হয় নি।
- মানে?
- মনে পড়ে? সেই দিনের কথা যেদিন এই বাড়িতে তোমার কাছ থেকে শোনা এক কথায় আঘাত পেয়ে এক মহিলা আত্মহত্যা করেছিল? কি বলে ছিলে তুমি তাকে সে কথা এখনো কেউ জানে না তুমি আজ এই মুহূর্তে নিজে সব কিছু বলবে। না হয় আমি সবার কাছে পৌছে যাব সবাই জানতে পেরে যাবে সেই ঘটনা।
- আমি কইতাছি আমি কইতাছি, আফসার সাহেবের স্ত্রীরে আমি রোজ মাইর খাইতে দেখতাম আমি তারে বেশ কয়েকবার বাঁচাইছিও কিন্তু সে আমারে তার প্রতিদান দেয় নাই, আমি যহন সামান্য টাকা চুরি করছিলাম তিনি সাহেবের কাছে সব কইয়া দিছিল, তারপর থেকা তার উপর আমার রাগ ছিল, একদিন সাহেব তারে আবার মারলেন আমি সেদিন একটা কাহিনী বানাইলাম, তারে কইলাম সাহেব আপনারে রোজ মারে কারন সে আপনারে ভালবাসেনা তার আর একটা স্ত্রী আর দুই সন্তান আছে, তিনি তালপর দিনই গলায় দড়ি দিল, উনি যে এই কাম করব তা আমি কোনদিন ভাবি নাই।
আদনান এক দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলল, - হুম বুঝলাম
- আপনি কাউরে বলবেন না তো এই কথা??
আদনান এক কুৎসিত হাসি দিয়ে বলল," আমি শুধু তোমার সাথেই কথা বলতে পারব আর কারও সাথে পারব না তবে আমি প্রকাশিত হব আজই প্রকাশিত হব, এক চিঠিতে প্রকাশিত হব এক অদ্ভুত ভাষায়, যদি আফসার সাহেব সেই ভাষা ধরতে না পারে তবে তুমি বেঁচে যাবে আর ধরতে পারলে তোমার কি হবে তা ভবিষ্যত বলে দিবে"।
আদনান রুম ছেড়ে চলে গেল। শফিক মিয়া আর কোন ছায়া মুর্তি দেখতে পারছেনা। আশাপাশে পাগলের মত খুঁজছে কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছেনা।
|৬|
আফসার সাহেব মিতুর হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে সোফায় বসলেন। মিতু ঠিক তার পাশে দাড়িয়ে আছে। চিঠির কথা শুনেই শফিক মিয়া আফসার সাহেবের আশেপাশে পাইচারি করতে শুরু করল। আফসার সাহেব চিঠিটা বিড়বিড় করে পড়তে শুরু করলেন,
জনাব আফসার সাহেব,
আপনার একটা বড় চিন্তার অবসান হয়ত আমি ঘটাতে পেরেছি। আমার বিশ্বাস মিতু ইতোমধ্যেই আগের মত স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এখন আমি আপনার আর একটা চিন্তার অবসান ঘটাব। আপনি জানতে চেয়েছিলেন "লভা কিসথা" মানে কি। এতা একটা সাধারণ বাক্য "ভাল থাকিস"। এই বাক্যের দুটি শব্দের অক্ষর গুলো কে একটু এলোমেলো করে লেখা হয়েছে। ভাল শব্দের ল তা আগে আর ভ তা পরে এবং থাকিস শব্দের ক আগে স মাঝে আর থ পরে বসানো হয়েছে। আর তেমন কিছুইনা। আপনি আমাকে ক্ষমার চোখে দেখবেন। আপনাদের কাউকে না বলেই চলে গেলাম।
লভা কবেথান।
ইতি
আদনান
আফসার সাহেব মাথা চুলকোতে চুলকোতে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, "লভা কথেবান মানে আবার কি?" এটা কোন অদ্ভুত ভাষা?"
এ কথা শুনেই শফিক মিয়া, আফসার সাহেবের পা ধরে কাঁদতে শুরু করল। আর বিরতিহীনভাবে বলতে লাগল," আমারে ক্ষমা কইরা দেন, আমারে ক্ষমা কইরা দেন"।
আদনান মালিবাগ মোড়ের উদ্দেশ্যে হাঁটছে। সেখান থেকে বাসে উঠে সোজা চলে যাবে চাচার বাসায়। হঠাৎ সে বুক পকেটে একটা কিছুর অস্তিত্ব খুঁজে পেল। হাত দিয়েই দেখল বিশ টাকার কচকচে নোট। সে দোকানে গিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। চিন্তাগ্রস্থ অবস্থায় সাধারন মানুষের মাথা কাজ করেনা যাদের করে তারা সাধারন না তারা অসাধারন। আফসার সাহেব খুবই সাধারন মানুষ। আদনানের বাক্য নিয়ে মজার খেলাটা বুঝিয়ে দেবার পরও যে "লভা কবেথান" এর অর্থ সে বুঝবেনা এ কথা ভাবতেই আদনানের ঠোঁটের কোণে দেখা গেল মৃদু হাসি। আদনানের দু'আঙ্গুলের ঝাটকায় ছুড়ে মারা সিগারেটের ফিল্টারটি পড়ে থাকল রাস্তার এক কোণে। আদনান হাঁটছে, সারিবেধে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের নিজ দিয়ে হাঁটছে। আর ক্ষনেক্ষনে ভিজে যাচ্ছে কৃ্ত্রিম জোৎন্সার কাক স্নানে।

Post a Comment

Previous Post Next Post